যুদ্ধক্ষেত্রে পিতাপুত্র (আবুল কাসিম ফেরদৌসি রূপান্তর: মমতাজউদদীন আহমদ)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - আনন্দপাঠ - | NCTB BOOK
91
91

যুদ্ধের সাজ পরে নিল সোহরাব। তার বর্শা আকাশের দিকে ঝলসিত হলো। সে যাবে শত্রু নিধনে, যে তার মাতুল বিন্দারজমকে গোপনে হত্যা করে গেছে। কিন্তু সবার আগে সে সন্ধান করবে জন্মদাতা মহাবীর রুস্তমের। পিতাকে পেলে সমস্ত ক্রোধ নির্বাপিত করে তাঁর বক্ষে মাথা রেখে দীর্ঘক্ষণ শান্তি লাভ করবে সোহরাব।
দুর্গের বন্দি সেনাপতি হুজিরকে নিয়ে সোহরাব পাহাড়ের শীর্ষে উঠল। ব্যাকুল সোহরাব বলল, 'ওই যে সবুজ রঙের শিবির, সেখানে এক বিশাল বীর গর্জন করছেন। আর তাঁর শিবিরের সম্মুখে প্রবল দুরন্ত অশ্ব অধীরতা প্রকাশ করছে, তাঁর পতাকায় আজদাহার চিত্র আঁকা আছে, তাঁর বর্শার ডগায় সিংহের মুখ, কে তিনি? বন্দি সেনাপতি, সত্য করে বলুন তো, তিনি কি মহাবীর রুস্তম?'

সোহরাবের ব্যাকুল প্রত্যশাকে ক্ষান্ত করে কৌশলী হুজির বললেন, ‘আপনার ধারণা সত্য নয়। ওই মহাবীরের প্রকৃত পরিচয় আমি জানি না। তিনি চীনদেশীয় একজন বীর বলে মনে হয়। তবে তিনি যে মহাবীর রুস্তম নন, সে বিষয়ে আমার কোনো ভ্রম নেই।’

সোহরাব বলল, 'তবে যে আমাকে আমার জননী বলে দিয়েছেন, ঠিক ওই রকম দেখতে, ঠিক ওই রকম দেহ মহাবীর রুস্তমের।'

সোহরাব: ওহে বন্দি, আমি তোমাকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমাকে বিশ্বাস করব না আমি। আর বিশ্বাস করলে এ সমরে আমার অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন হবে।

হুজির : আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি মহত্তম বীর।

সোহরাব: আপনারা কেউ আমার চিত্তের সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাবেন না।
সোহরাব বেদনায় অস্থির হয়ে ছুটে গেল। তুর্কি সেনাপতি হুমান ও বারমানকে বারবার জিজ্ঞাসা করল, 'আপনারাও কি বন্দি হুজিরের মতো অনুমান করেন, এ সমরে মহাবীর রুস্তম অংশগ্রহণ করেননি?' আফ্রাসিয়াবের চতুর সেনাপতিদ্বয় বলল, 'আমরাও শুনেছি মহাবীর রুস্তম ক্ষুব্ধ হয়ে জাবলুস্তান ফিরে গেছেন। তিনি এ যুদ্ধে সম্রাট কায়কাউসকে রক্ষা করার জন্য উপস্থিত থাকবেন না।'

ব্যাকুল সোহরাবের সমস্ত প্রত্যাশা মিথ্যার পাথরে আছাড় খেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে লাগল। বন্দি হুজির ভয়ংকর মিথ্যা বললেন কেন? তিনিও কি হুমান ও বারমানের সঙ্গে কূটকৌশলে যুক্ত হয়ে পিতাপুত্রকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চান? নাকি এ তার দেশপ্রেম? যে প্রেমের জন্য তিনি সোহরাবকে সুযোগ দেবেন না রুস্তমকে অতর্কিত আক্রমণ করতে। নাকি সব নিয়তির লীলা! বাস্তবিকই মানুষ বড়ো অসহায় নিয়তির লীলার কাছে। তৃষ্ণার্ত যুবক ছুটে এসেছে না-দেখা পিতার সন্ধানে। যে পিতাকে জগতের সবাই চেনে, যাঁর গৌরবে ইরান বিমুগ্ধ, সেই পিতাকে তার পুত্র এত কাছে এসেও চিনতে পারছে না। কেন এমন হলো, এমন কেন হয় মানবভাগ্য?

ক্ষুব্ধ সোহরাব অতি দ্রুত সজ্জিত করল নিজেকে। বর্শা, গদা, পাশ ও সুরক্ষিত বর্মে আচ্ছাদিত করল দেহ। দুরন্ত অশ্বকে নিয়ে বায়ুবেগে ছুটে গেল ইরানিদের প্রান্তরে। শত্রুসৈন্যদের সমাবেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সোহরাব সরাসরি চলে এল সম্রাট কায়কাউসের শিবিরের কাছে। আহ্বান করল সম্রাটকে, মহান অধিপতি, আমার আহ্বান শ্রবণ করুন। আমি যুদ্ধে আহ্বান করছি আপনার বীর উত্তমদের। আর কোথায় আপনার মহত্তম বীর রুস্তম? শুনেছি তিনি জাবুলন্তান চলে গেছেন, তাঁকেও আহ্বান করে আনুন। আমি যুদ্ধ চাই।

ক্ষুব্ধ সোহরাব অতি দ্রুত সজ্জিত করল নিজেকে। বর্শা, গদা, পাশ ও সুরক্ষিত বর্মে আচ্ছাদিত করল দেহ। দুরন্ত অশ্বকে নিয়ে বায়ুবেগে ছুটে গেল ইরানিদের প্রান্তরে। শত্রুসৈন্যদের সমাবেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সোহরাব সরাসরি চলে এল সম্রাট কায়কাউসের শিবিরের কাছে। আহ্বান করল সম্রাটকে, মহান অধিপতি, আমার আহ্বান শ্রবণ করুন। আমি যুদ্ধে আহ্বান করছি আপনার বীর উত্তমদের। আর কোথায় আপনার মহত্তম বীর রুস্তম? শুনেছি তিনি জাবুলন্তান চলে গেছেন, তাঁকেও আহ্বান করে আনুন। আমি যুদ্ধ চাই।

সোহরাবের আহ্বানে সম্রাট কায়কাউস ভীত এবং সচকিত হলেন। যুবকের আহ্বানে ইরানের সেনাপতিবৃন্দ সন্ত্রস্ত হলেন। তার সম্মুখে যাওয়ার সাহস কারও নেই।

এ সংকটকালে একমাত্র রক্ষাকারী মহাবীর রুস্তম। তাঁকে শীঘ্র সংবাদ দেওয়ার হোক। তিনি যদি অভিমান করে এ বালকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সম্মত না হন, তখন কী হবে?
সেনাপতি গেও গেলেন রুস্তমের শিবিরে সম্রাটের অনুরোধ নিয়ে। গেও বললেন, তুরানের এক যুবক বারবার আপনার নাম আহ্বান করছে। সে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়।

রুস্তম : আমি কেন সেই সামান্য বালকের সঙ্গে যুদ্ধ করব?
গেও : ইরানের গৌরবের জন্য, ইরান রক্ষার জন্য।
রুস্তম : সংকটকালেই আমার ডাক পড়ে। আমি এবার কেবল যুদ্ধ দেখব, যুদ্ধে লিপ্ত হব না।
গেও : সম্রাটের পরামর্শ, আপনি আত্মপরিচয় গোপন রেখে তুরানি বীরের মোকাবিলা করবেন। সে জানবে আপনি রুস্তম নন, রুস্তমের অনুচরমাত্র।
রুস্তম : আমার শিরস্ত্রাণ, প্রহরণ, আমার বর্শা আর বর্ম দেখলে সে বুঝে নেবে আমিই রুস্তম।
গেও : তাহলে কি অবাধ্য যুবকের দম্ভ মেনে নিয়ে আপনি এ যুদ্ধে নীরব থাকবেন?
রুস্তম
চুপ করো। রুস্তমকে যুদ্ধের বিষয়ে উপদেশ দিয়ো না। যাও, তোমার নির্বোধ সম্রাটকে বলো, আমি যুদ্ধে যাব এবং তুরানি বালকের দম্ভ মৃত্তিকায় লুণ্ঠিত করে তার আশঙ্কা দূর করব।
গেও : আপনি সত্যিই মহান বীর। আপনি প্রকৃত ইরান-ভরসা।
মনের আনন্দে গেও চলে গেলেন। রুস্তম মনে মনে কৌশল করে নিলেন। তুরানি বালকের কাছে তিনি নিজ পরিচয়ে উদ্‌ঘাটিত হবেন না।

সামান্য অনুচর হিসেবে সজ্জিত হলেন রুস্তম। হাস্যমুখে শিবির থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। কিন্তু তাঁর সম্মুখে অবিচল পর্বতের মতো অশ্বপৃষ্ঠে সমাসীন সোহরাব। আজ দিনের আলোতে সোহরাবকে দেখে প্রথম দৃষ্টিতে রুস্তম অভিভূত হয়ে গেলেন। এ তো কোনো তুরানি বীর নয়, এ তো ইরানের সন্তান। এ বালকের মুখ তো মহাবীর সামের মুখ। এ বালক কে? কে এই যুবককে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরণ করেছে? সে যদি তার জন্মদায়িনী মাতা হয়, তাহলে ভুল করেছে। আমি তো এ বালককে এখনই চির অন্ধকার মৃত্যুর গহ্বরে নিক্ষেপ করব।
আর অশ্বপৃষ্ঠে সমাসীন সোহরাব বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে অবিচল তাকিয়ে আছে রুস্তমের দিকে। কে ইনি? ইনিই কি সেই মহাবীর, যার বিষয়ে আমার মা আমাকে বহু কথা বলেছেন।

সোহরাব: আপনি!
রুস্তম : তুমি?
সোহরাব আমি সোহরাব।
রুস্তম : আমি রুস্তম নই।
সোহরাব : কে আপনি?
রুস্তম : আমার পরিচয় জানার জন্য তোমাকে পর্বতের ওই নির্জন পাদদেশে যেতে হবে। নিভৃতে আমার পরিচয় দেব তোমাকে।
সোহরাব: আপনি কখনও সামনগা গিয়েছেন?
রুস্তম : সামনগা যাওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার কোনোদিন হয়নি।
সোহরাব: তাহলে আমি যা শুনেছি সব অলীক?
রুস্তম : বালক, তোমার সঙ্গে কেবল যুদ্ধের কথা বলব, সামান্য তুচ্ছ বিষয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করলে আমার প্রভু রুষ্ট হবেন।
সোহরাব: কে আপনার প্রভু?
রুস্তম : আমার প্রভু মহাবীর রুস্তম।
সোহরাব : কোথায় তিনি?
রুস্তম : আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে যদি জীবিত থাকো, তাহলে তোমাকে কেউ না-কেউ বলে দেবে মহাবীর রুস্তম কোথায়? কিন্তু তুমি আদৌ সে সৌভাগ্য নিয়ে ইরানে পদার্পণ করেছ, তা মনে করি না।

রুস্তম ও সোহরাব কোনোভাবেই একে অপরকে চিনতে পারল না। যুদ্ধপ্রান্তরে উভয়ের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে, সেখানে স্নেহ ও প্রেমের স্থান নেই। পশু তার সন্তানকে হয়তো চিনতে পারে, স্রোতের মাছ হয়তো তার শাবকদের স্নেহদান করে, কিন্তু প্রতিহিংসার অনলে দন্ধীভূত মানবপিতা তার পুত্রকে অথবা মানবপুত্র তার পিতাকে চিনতে পারে না।

পাহাড়ের পাদদেশে সংকীর্ণ প্রান্তরে দুই বীরের যুদ্ধ চলছে। বর্শার যুদ্ধ, গদার যুদ্ধ। দুজনের দুর্দমনীয় যোগ্যতা। দুজনের অশ্ব ক্লান্ত হলো। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আসন পড়ে গেল। রুস্তম ভাবছেন, এ কোন অজেয় বীর যে আমার এত কালের অহংকার চূর্ণ করার জন্য এসেছে? আর সোহরাব ভাবছে, এই যদি রুস্তমের অনুচর হয়, তাহলে আমার পিতার শৌর্য কত প্রবল!
রুস্তম সোহরাবের কটিদেশের বন্ধন ধরে টান দিলেন। কিন্তু সোহরাবকে এক চুলও নড়াতে পারলেন না। সোহরাব গদা দিয়ে আঘাত করল রুস্তমকে। ব্যথা পেলেন রুস্তম, তাঁর হাতে রক্ত।
সোহরাব বলল, 'আপনাকে আর আঘাত করব না। আপনাকে আঘাত করলে সংকোচ আর ব্যথা হয় আমার। শিবিরে ফিরে যান আপনি।'
রুস্তম ক্রোধান্ধ হলেন। ছুটে গেলেন তুরানিদের মধ্যে। অকাতরে হত্যা করলেন সৈন্যদের। সোহরাবও ছুটে গেল ইরানিদের মধ্যে, সে-ও হত্যা করল বহু ইরানি সৈন্য।
রুস্তম ঘোড়া ছুটিয়ে এসে সোহরাবকে বললেন, 'এ তুমি কী করছ?'
সোহরাব বলল, 'আপনি যা করলেন তার শোধ নিলাম আমি।'

ক্ষুব্ধ ও বিমর্ষ রুস্তম চলে গেলেন শিবিরে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, 'আজ অন্ধকার নেমে আসছে কাল প্রভাতে এইখানেই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে এসো।'
সোহরাব মৃদু হেসে বলল, 'আপনিও প্রস্তুত থাকবেন।'
সম্রাট কায়কাউসের কাছে নত মস্তকে এলেন রুস্তম। যুবক বীরের শৌর্যের বিবরণ শুনে সম্রাট বিস্মিত হয়ে বললেন, সে এমন কোন বীর, যে আপনার যোগ্যতাকেও বিপন্ন করেছে। মহাবীর আপনি, মোটেই বিষণ্ণ হবেন না, নিবিড় ঘুমে রাত্রিযাপন করুন। আপনার বিজয়ের জন্য সমস্ত রাত ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করব আমি।
রুস্তম এলেন নিজের শিবিরে। বীর গেওকে পুনরায় বললেন, তুরানি যুবক বীরের কথা। বালককে দেখামাত্রই তাঁর চিত্তে যে নিদারুণ স্নেহধারা উত্থিত হয়, তা-ও বললেন।
সোহরাব এল শিবিরে। তার মনেও ভীষণ অনিশ্চয়তা। কে এই অজানা মহৎ বীর, যাঁর অস্ত্রচালনা, বর্শা-নিক্ষেপ, গদার গতি অতি দক্ষ ও সুচারু। অথচ তাঁকে কেউ চিনতে পারে না।
এই নাম-না-জানা বীরকে দেখামাত্রই তার যুদ্ধ বাসনা হারিয়ে যায় কেন? তাঁকে আঘাত করতে তার চিত্ত ব্যাকুল হয় কেন? তার বাহুর রক্ত দেখে চিত্ত বিচলিত হয় কেন?

আগামীকাল প্রভাতে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা হবে। সে প্রভাত আর কতকাল পরে আসবে? তাঁকে পুনরায় দেখার জন্য যে আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। সেনাপতি হুমান, আপনি বলুন এ মহাবীর কে? আমার মা যে বর্ণনা দান করেছেন, তার সঙ্গে এ বীরের অনেক কিছু মিলে যাচ্ছে। অথচ আপনারা বলছেন, মহাবীর রুস্তম এ সমরে উপস্থিত নেই। হুমান বললেন, 'হাঁ তা-ই। আপনি এ নিয়ে আর চিন্তা করবেন না। যে মহাবীরের সঙ্গে লিপ্ত আছেন, তাকে কাল প্রভাতে নিধন করে নিশ্চিত মনে পিতার কথা চিন্তা করবেন। এখন নিঃশব্দ নিদ্রায় রাত্রি অতিবাহিত করুন। বিশ্রাম আপনাকে সাহায্য করবে।'
সোহরাব হুমানের কথা শুনে শয্যাগ্রহণ করতে গেল। রাত্রির অবসান হলো। পাহাড়ের অন্তরাল থেকে সূর্যের রক্তিম আভা বিস্তার লাভ করল। পাখিরা কূজন করল।
মহাবীর রুস্তম এলেন প্রান্তরে। শূন্য প্রান্তরে সোহরাব তখনও উপস্থিত হননি। রুস্তমের চিত্ত অকস্মাৎ শূন্য হয়ে উঠল।

সোহরাব এল। তাকে দেখে আনন্দ পেলেন রুস্তম। সম্ভাষণ বিনিময় হলো দুজনের। তরুণ সোহরাব প্রবীণ রুস্তমকে বিনীতভাবে বলল, 'আপনাকে যা বলব, তা একান্ত আমার কথা। আমি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। যে চায়, সে যুদ্ধে লিপ্ত হোক, আমি আর আপনি যুদ্ধ করব না। আমরা বসে বসে অনেক কথা বলব। জীবনের কথা, আনন্দের কথা, শান্তির কথা। প্রয়োজনে আমরা পরিচয় বিনিময় করব। আপনি জেনে নেবেন আমি কে, আমি জেনে নেব আপনি কে? গতকাল আপনার সঙ্গে আমার যুদ্ধ হয়েছে। আপনার দক্ষতা ও বীরত্বের সন্ধান পেয়ে আমার মনে বারবার দ্বন্দ্ব হয়েছে, আপনি স্বয়ং মহাবীর রুস্তম। আজ আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, আমাকে বলুন কে আপনি, কোথা থেকে এসেছেন এ যুদ্ধে?'

রুস্তম সোহরাবের প্রশ্নে বিচলিত হলেন। বারবার মিথ্যা বলতে দ্বিধা হলো তাঁর। তিনি বলতে উদ্যত হলেন আমিই রুস্তম। কিন্তু প্রবীণ যোদ্ধা সংশয়ের কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে বললেন, 'আমি দাঁড়ালাম, তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছি আমি, যুদ্ধই আমার কাম্য। আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হও। না-হয় ভীত শাবকের মতো পলায়ন করে লজ্জিত জননীর কোলে আত্মগোপন কর।'

রুস্তমের বিদ্রূপবাক্যে সোহরাব উত্তেজিত হলো। ত্বরিত প্রস্তুত করল নিজেকে। ছুটে এল রুস্তমের মুখোমুখি।
শুরু হলো দুই মহান বীরের মধ্যে মল্লযুদ্ধ। দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনী দূরে দাঁড়িয়ে অভূতপূর্ব যুদ্ধ লক্ষ করছে। ধুলায় ধূলাকার হয়ে গেল প্রান্তর। দুই বীরের গর্জনে আকাশ মুখরিত। ঘর্মাক্ত ও ক্লান্ত হলেন প্রবীণ রুস্তম। সোহরাব এক প্রবল চাপ সৃষ্টি করে মহাবীর রুস্তমকে ভূপাতিত করল এবং বিদ্যুৎ গতিতে লাফ দিয়ে তাঁর বুকে চেপে বসল। সোহরাব কোমর থেকে টেনে নিল তীক্ষ্ণধার ছুরি। এখন প্রবীণ ও দাম্ভিক বীরের শির বিচ্ছিন্ন করবে সে।

সোহরাবের অমিত শক্তির নিচে পড়ে আছেন মহাবীর রুস্তম। সোহরাবের তীক্ষ্ণ ছুরির আঘাতে রুস্তমের প্রাণবায়ু চলে যাবে। সোহরাব তার দুশমনকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে দেরি করছে কেন? সামান্য দেরি তো তার জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। তবু সোহরাব আরও একবার শত্রুর মুখ ভালো করে দেখে নিল।

আর মহাবীর রুস্তম তাঁর অপরিমেয় অভিজ্ঞতার গুণে রক্ষা লাভের একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। কিশোর বীর সোহরাবকে বললেন, 'ওহে তুরানি বীর, আমাকে যে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছ, তুমি কি যোদ্ধার প্রকৃত ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জান না?'

সোহরাব কী ধর্ম? শত্রুকে হত্যা করতে ধর্মের কী প্রয়োজন?
রুস্তম : তোমার মতো ধর্মহীন তুরানি বীর তো জানে না, ইরানি বীরের একটি ধর্ম আছে। তা হলো, সমকক্ষ বীরকে প্রথম পরাজয়ের কালে হত্যা করা অন্যায়। তাকে আর একটি সুযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়বার পরাজিত হলেই তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে হত্যা করতে পার।

সোহরাব: আমি এমন ধর্মের কথা আগে শুনিনি। কিন্তু তুমি প্রবীণ যোদ্ধা, তোমার কথা অবশ্যই ঠিক।
রুস্তম : হাঁ ঠিক।
সোহরাব: ইরানের মহাবীর রুস্তম কি তোমার এই ধর্ম মেনে চলেন?
রুস্তম : নিশ্চয়।
সোহরাব: তাহলে তোমাকে নিঃসংকোচে মুক্তি দিলাম। এখন বিশ্রামের জন্য চলে যাও। দ্বিতীয়বার পরাজিত হওয়ার জন্য এখানেই চলে এসো। তখন তোমার মৃত্যু ঘটবে।
সোহরাব ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল। ক্লান্ত রুস্তম জীবন ভিক্ষা নিয়ে ধীরে ধীরে নদীতীরে অগ্রসর হলেন। আজ তিনি যেমন অবসন্ন, তেমনি মন তাঁর মিথ্যাচারে জর্জরিত। এত বড়ো নিদারুণ লজ্জা তিনি দীর্ঘ জীবনে কোনোদিন পাননি।

তুরানি সেনাপতি হুমান শুনলেন, সোহরাব ভূপাতিত রুস্তমকে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। তিনি অনুশোচনায় চিৎকার করে উঠলেন, 'এ আপনি কী করেছেন সোহরাব? জানেন কি, আপনি কাকে মুক্ত করেছেন?'
সোহরাব সচকিত হয়ে বলল, 'কে তিনি?'
হুমান মুহূর্তের মধ্যে সাবধান হয়ে বললেন, 'তিনি নিশ্চয় ইরানের একজন প্রধান বীর।'
সোহরাব হেসে উঠে বলল, 'একজন কেন, দশজন বীরকে আমি ছেড়ে দেব। আমি ইরানে এসেছি মহাবীর রুস্তমের সঙ্গে মিলিত হতে, আমি এখানে যুদ্ধ করতে আসিনি।'

নদীর স্রোতের মধ্যে নেমে রুস্তম বারবার শীতল পানি দিয়ে নিজের মুখ ধুয়ে নিলেন। ধুলায় ধূসরিত শরীর মার্জনা করলেন। বড়ো পিপাসার্ত তিনি। অঞ্জলি ভরে পানি তুলে বারবার পান করলেন। লজ্জায় দুঃখে তাঁর মন এখন অবসন্ন হয়ে আছে। জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় সৃষ্টিকর্তা তাঁকে নিয়ে এ কী নিষ্ঠুর খেলা খেলছেন। সামান্য এক বালকের হাতে তিনি আজ পরাজিত হয়েছেন। অপরিচিত অপরিজ্ঞাত সে বালকের কী পরিচয়?
সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে রুস্তম দুই হাত তুললেন। কাতর কণ্ঠে প্রভুর করুণা প্রার্থনা করলেন, 'হে প্রভু, আমাকে শক্তি দাও, গৌরব সংরক্ষণের শৌর্য দাও আমাকে। এতকাল তুমি আমাকে গৌরবে শীর্ষস্থানীয় করেছ, আজ কোন অপরাধে তুমি আমাকে লাঞ্ছিত করছ? আমার করুণ আবেদন শ্রবণ কর মহান প্রভু।'

মহাবীর রুস্তমের মনে হলো, মহান প্রভু আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। অমিত শক্তির উত্থান ঘটেছে তাঁর শরীরে। পুনরায় হয়েছেন তিনি অজেয়। কৃতজ্ঞতায় রুস্তমের মন ভরে উঠল। তিনি নদীর স্রোত থেকে উঠে এলেন।
এগিয়ে গেলেন যুদ্ধের নিরালা প্রান্তরে। এবার তিনি শৌর্যে স্থির।

দিন গেল। রাত্রি এল। এল নব প্রভাত। ওই তো যুবক ধীরে ধীরে আসছে। যুবকের মুখে মনজুড়ানো সেই স্নিগ্ধ হাসি। যুবকের মুখমণ্ডলে প্রগাঢ় কিরণ। রুস্তমের চিত্ত আবার ব্যাকুল হলো। তবে তা মাত্র ক্ষণিকের জন্য।

শুরু হলো মল্লযুদ্ধ। প্রখর উজ্জ্বল সূর্য ঈশ্বরের প্রতিভূ হয়ে দেখছে পিতা-পুত্রের যুদ্ধ। পুত্র যুদ্ধ করছে পিতার প্রতি সহানুভূতি ধারণ করে। আর পিতা যুদ্ধ করছেন স্বীয় গৌরব সংরক্ষণের জন্য। আজ সোহরাব বড়ো অস্থির, বড়ো চঞ্চল তার মন। ভিন্ন চিন্তায় অন্যমনস্ক সোহরাব অকস্মাৎ পড়ে গেল মাটিতে। মহাবীর রুস্তম তৎক্ষণাৎ তার বুকে বসে পড়লেন দেহের সমস্ত শক্তি নিয়ে।

সোহরাব তবু হাসছে। রুস্তম টেনে নিলেন তীক্ষ্ণ ছুরিকা। সোহরাব তবু হাসছে। রুস্তম উদ্যত করলেন তীক্ষ্ণ ছুরিকা। সোহরাব বলল, 'ওহে বীর, এ আমার প্রথম বারের পরাজয়। দ্বিতীয়বার যুদ্ধের জন্য আমাকে মুক্ত কর।
বীরের ধর্ম পালন কর।'
রুস্তম বললেন, 'শত্রুকে করতলগত করে কোন বীর কোথায় তাকে মুক্ত করেছে হে নির্বোধ বালক?'
রুস্তম বিলম্ব না করে তীব্রভাবে তীক্ষ্ণ ছুরিকা ঢুকিয়ে দিলেন সোহরাবের বক্ষে। সোহরাবের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। আর্তনাদ করল সোহরাব।

আক্রমণকারীকে ব্যথিত কন্ঠে চিৎকার করে সোহরাব বলল, 'ওরে কাপুরুষ, ইরানি বীর, তুই যা করলি, তার জন্য তোকে সমুচিত শাস্তি পেতে হবে। নির্মম শাস্তি হবে তোর। যদি তুই মাছ হয়ে সাগরের নিচে পালিয়ে থাকিস, যদি বায়ু হয়ে আকাশে মিশে যাস, যদি অগ্নি হয়ে সূর্যের মধ্যে গোপন হোস, আর যদি অন্ধকার হয়ে রাত্রির মধ্যে আশ্রয় লাভ করিস, তবু তোর নিস্তার নেই।'
রুক্তম : কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
সোহরাব: নিশ্চয়ই পারবে। যখন ইরানের মহাবীর রুস্তম শুনতে পাবেন তাঁর পুত্র সোহরাবকে তুই অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করেছিস, তখন তোর নিস্তার থাকবে না।
রুস্তম সোহরাব! রুস্তমের পুত্র তুই? মিথ্যা কথা। না, আমার কোনো পুত্র নেই। আমার পুত্র যুদ্ধ করতে আসেনি।
সোহরাব: তুমি রুস্তম! বলো, তুমিই রুস্তম। বলো-
রুস্তম: হাঁ, আমিই রুস্তম।
সোহরাব: পিতা, আমার জন্মদাতা তুমি। আমাকে ছলনা কোরো না পিতা, আমার শেষ বিদায় কালে আমাকে সত্য বলো, তুমি সেই রুস্তম, আমার স্নেহময়ী মাতা তহমিনার স্বামী তুমি, তুমিই আমার পিতা। বলো, আবার বলো।
রুস্তম: হাঁ, আমিই, আমিই। কিন্তু আমি তো জানি-

মহাবীর রুস্তমের মনে হলো, মহান প্রভু আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। অমিত শক্তির উত্থান ঘটেছে তাঁর শরীরে। পুনরায় হয়েছেন তিনি অজেয়। কৃতজ্ঞতায় রুস্তমের মন ভরে উঠল। তিনি নদীর স্রোত থেকে উঠে এলেন।
এগিয়ে গেলেন যুদ্ধের নিরালা প্রান্তরে। এবার তিনি শৌর্যে স্থির।
দিন গেল। রাত্রি এল। এল নব প্রভাত। ওই তো যুবক ধীরে ধীরে আসছে। যুবকের মুখে মনজুড়ানো সেই স্নিগ্ধ হাসি। যুবকের মুখমণ্ডলে প্রগাঢ় কিরণ। রুস্তমের চিত্ত আবার ব্যাকুল হলো। তবে তা মাত্র ক্ষণিকের জন্য। শুরু হলো মল্লযুদ্ধ। প্রখর উজ্জ্বল সূর্য ঈশ্বরের প্রতিভূ হয়ে দেখছে পিতা-পুত্রের যুদ্ধ। পুত্র যুদ্ধ করছে পিতার প্রতি সহানুভূতি ধারণ করে। আর পিতা যুদ্ধ করছেন স্বীয় গৌরব সংরক্ষণের জন্য। আজ সোহরাব বড়ো অস্থির, বড়ো চঞ্চল তার মন। ভিন্ন চিন্তায় অন্যমনস্ক সোহরাব অকস্মাৎ পড়ে গেল মাটিতে। মহাবীর রুস্তম তৎক্ষণাৎ তার বুকে বসে পড়লেন দেহের সমস্ত শক্তি নিয়ে।
সোহরাব তবু হাসছে। রুস্তম টেনে নিলেন তীক্ষ্ণ ছুরিকা। সোহরাব তবু হাসছে। রুস্তম উদ্যত করলেন তীক্ষ্ণ ছুরিকা। সোহরাব বলল, 'ওহে বীর, এ আমার প্রথম বারের পরাজয়। দ্বিতীয়বার যুদ্ধের জন্য আমাকে মুক্ত কর।
বীরের ধর্ম পালন কর।'
রুস্তম বললেন, 'শত্রুকে করতলগত করে কোন বীর কোথায় তাকে মুক্ত করেছে হে নির্বোধ বালক?'
রুস্তম বিলম্ব না করে তীব্রভাবে তীক্ষ্ণ ছুরিকা ঢুকিয়ে দিলেন সোহরাবের বক্ষে। সোহরাবের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। আর্তনাদ করল সোহরাব।
আক্রমণকারীকে ব্যথিত কন্ঠে চিৎকার করে সোহরাব বলল, 'ওরে কাপুরুষ, ইরানি বীর, তুই যা করলি, তার জন্য তোকে সমুচিত শাস্তি পেতে হবে। নির্মম শাস্তি হবে তোর। যদি তুই মাছ হয়ে সাগরের নিচে পালিয়ে থাকিস, যদি বায়ু হয়ে আকাশে মিশে যাস, যদি অগ্নি হয়ে সূর্যের মধ্যে গোপন হোস, আর যদি অন্ধকার হয়ে রাত্রির মধ্যে আশ্রয় লাভ করিস, তবু তোর নিস্তার নেই।'

রুস্তম : কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
সোহরাব: নিশ্চয়ই পারবে। যখন ইরানের মহাবীর রুস্তম শুনতে পাবেন তাঁর পুত্র সোহরাবকে তুই অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করেছিস, তখন তোর নিস্তার থাকবে না।
রুস্তম: সোহরাব। রুস্তমের পুত্র তুই? মিথ্যা কথা। না, আমার কোনো পুত্র নেই। আমার পুত্র যুদ্ধ করতে আসেনি।
সোহরাব: তুমি রুস্তম! বলো, তুমিই রুস্তম। বলো-
রুস্তম: হাঁ, আমিই রুস্তম।
সোহরাব: পিতা, আমার জন্মদাতা তুমি। আমাকে ছলনা কোরো না পিতা, আমার শেষ বিদায় কালে আমাকে সত্য বলো, তুমি সেই রুস্তম, আমার স্নেহময়ী মাতা তহমিনার স্বামী তুমি, তুমিই আমার পিতা। বলো, আবার বলো।
রুস্তম: হাঁ, আমিই, আমিই। কিন্তু আমি তো জানি-

সোহরাব: কী জান তুমি? আমার বর্ম উন্মোচন করো। আমার দক্ষিণ বাহুতে তোমার স্বর্ণকবচ দেখ। মহাবীর সামের হাতের কবচ তুমি দিয়েছিলে আমার জননীকে। আমাকে পুত্র বলে আহ্বান কর, আমাকে বক্ষে ধারণ করো পিতা।

রুস্তম: হাঁ, এই তো, এই সেই স্বর্ণকবচ। আমিই দিয়েছিলাম তহমিনাকে। ওরে পুত্র, ওরে সোহরাব, এ কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেল। করুণাময় মহাপ্রভু, আমি তো নিজপুত্রকে নিজহাতে হত্যা করার জন্য তোমার কাছে শক্তি প্রার্থনা করিনি।

রক্তের ধারায় সিক্ত সোহরাব পিতার বক্ষে আশ্রয় নিয়েছে। রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ধরণী। মধ্যাহ্নের সূর্য ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। পিতা রুস্তম তীব্র যন্ত্রণায় নিজের শরীরকে নখের আঁচড় দিয়ে ছিন্ন করছেন।

মহাবীর রুস্তম এবং সামানগা-কন্যা তহমিনার একমাত্র সন্তান সিংহশাবক সোহরাব ঘুমিয়ে পড়ল। গাঢ় ঘুম, অনন্ত ঘুম। কার সাধ্য তাকে আর জাগায়?

common.content_added_by

লেখক-পরিচিতি

33
33

আবুল কাসিম ফেরদৌসির জন্ম ৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে (কারও কারও মতে ৯৪১ খ্রি.) ইরানের খোরাসান প্রদেশের তুস নগরে। নিরলস ৩০ বছর পরিশ্রম করে ফেরদৌসি 'শাহনামা' কাব্যটি রচনা করেন। এটি ইরানের জাতীয় মহাকাব্য। এ কাব্যের প্রতিটি চরণ রচনার জন্য এক দিনার করে কবি ষাট হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) পাওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে ঘাট হাজার দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) দেন। সম্ভ্রম-সচেতন কবি ক্ষোভে-দুঃখে সুলতান মাহমুদের গজনি ছেড়ে বাগদাদে চলে আসেন। সুলতান মাহমুদের দূত স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও তিনি আর ফিরে যাননি গজনিতে। শেষজীবনে কবি তাঁর মাতৃভূমি তুস নগরে ফিরে আসেন। গভীর মনোবেদনা নিয়ে পরিণত বয়সে ১০২০ খ্রিষ্টাব্দে মহাকবি ফেরদৌসি মৃত্যুবরণ করেন।

common.content_added_by

রূপান্তরকারী লেখক-পরিচিতি

33
33

মমতাজউদদীন আহমদের জন্ম ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়। তিনি প্রধানত নাট্যকার ও অভিনেতা। কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে তাঁর সরকারি কলেজে শিক্ষকতায়। তাঁর? বিপুল রচনাবলির মধ্যে রয়েছে নাট্যবিষয়ক গবেষণা, মৌলিক ও রূপান্তরিত নাটক এবং বিচিত্র বিষয়ে গদ্যরচনা। তাঁর বিখ্যাত মৌলিক নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা', 'কি চাহ শঙ্খচিল', 'সাত ঘাটের কানাকড়ি' প্রভৃতি। সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, একুশে পদক ও শিশু একাডেমি পুরস্কার। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে মমতাজউদদীন আহমদ মৃত্যুবরণ করেন।

common.content_added_by

পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব

36
36

ফেরদৌসির মহাকাব্য 'শাহনামা' থেকে মূলভাব গ্রহণ করে গল্পটি লেখা হয়েছে। ইরানের পাশের শান্তিপ্রিয় দেশ সামনগার রাজকন্যা তহমিনাকে বিয়ে করেন মহাবীর রুস্তম। বিয়ের অল্পকালের মধ্যে রুস্তম তাঁর রাজ্য ইরানে ফিরে যান। তহমিনার গর্ভে জন্ম নেয় রুস্তমের সন্তান বীর সোহরাব ছেলে জন্মানোর সংবাদ পেলে রুস্তম সন্তানকে তাঁর মতোই যুদ্ধে নিয়ে যাবে- এ ভয়ে মা তহমিনা স্বামী রুস্তমকে খবর পাঠান একটি কন্যা সন্তানের জন্য হয়েছে। এ থেকেই মূল বেদনা-গাথার শুরু। 'যুদ্ধক্ষেত্রে পিতাপুত্র' মহাবীর রুস্তম কীভাবে পুত্র সোহরাবকে হত্যা করল সেই বেদনামাখা কাহিনি। এখানে দেখা যায়, ছেলে সোহরাব পিতার খোঁজে এসেছে ইরান, কিন্তু কেউই রুস্তমের সন্ধান দিতে পারছে না। অথচ নিজেরই অজ্ঞাতে তরবারি ধরতে হলো পিতার বিরুদ্ধে এবং মৃত্যুও হলো তার। মৃত্যুর সময় দুজন জানতে পারল যে, সম্পর্কে তাঁরা আসলে পিতা ও পুত্র। মহাবীর রুস্তম অচেনা তুরানি বালকের কাছে পরাজিত না হওয়ার জন্য বীরত্বকে বিসর্জন দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। নিজের হাতে ছুরিবিদ্ধ করে আপন সন্তানের বুক। পরিচয় পাওয়ার পর জীবনে নেমে আসে হাহাকার।

জয় বা বীরত্ব কাঙ্ক্ষিত ও প্রশংসনীয়। কিন্তু বীরত্বের নামে প্রতারণা জীবনে বয়ে আনতে পারে চরম মানবীয় বিপর্যয়- যা এ গল্পের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টীকা

36
36

নিধন - হত্যা।
মাতুল- মামা।
নির্বাপিত - নিবে গিয়েছে এমন।
দুর্গ - সৈন্য থাকার স্থান।
চূর্ণ-বিচূর্ণ - গুঁড়া গুঁড়া হওয়া।
কূটকৌশল -চতুর কৌশল।
নিয়তির লীলা - ভাগ্যের খেলা।
বিমুগ্ধ - বিশেষভাবে মুগ্ধ।
দুরন্ত - অশান্ত, ভীষণ।
বীরোত্তম - বীরদের মধ্যে উত্তম।
মহত্তম - সবচেয়ে মহৎ।
সংকটকাল - বিপদের সময়।
শিরস্ত্রাণ - যুদ্ধে মাথায় পরার বর্ম বিশেষ।
দম্ভ - অহংকার।
নিষ্ক্রান্ত - চলে যাওয়া।
অলীক - মিথ্যা, অপার্থিব।
পদার্পণ - পা রাখা, আসা।
অনুশাসন - আইন, প্রথা।
দুর্দমনীয় - যা সহজে দমন করা যায় না।
শৌর্য - বীরত্ব, সাহস।
ক্রোধান্ধ - ক্রোধে অন্ধ।
শিবির - তাঁবু। সেনা-নিবাস। -
বিপন্ন - বিপদগ্রস্ত।
মল্লযুদ্ধ - কুস্তি, অস্ত্র ছাড়া যে যুদ্ধ।
তীক্ষ্ণধার - খুব ধারাল।
অমিত - অপরিমিত, প্রচুর।
অপরিমেয় - অসংখ্য, পরিমাণ করা যায় না এমন।
জর্জরিত - নিপীড়িত, জীর্ণ।
অনুশোচনা - পরিতাপ, খেদ।
করতলগত - নাগালের মধ্যে। মুঠোর ভেতরে।
স্বর্ণকবচ - সোনা দিয়ে বানানো মাদুলি বা তাবিজ।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion